|
থায়ী কমিটির কাছে পাঠানো মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সনদ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। এখানেই শেষ নয়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নিুমানের শিক্ষক নিয়োগ দেয়। এদের চুক্তি অনুযায়ী বেতন-ভাতা দেয় না। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত স্বল্প ও অনিয়মিতভাবে বেতন প্রদান করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিন্ন বেতন কাঠামো না থাকায় সমপদমর্যাদার শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একই হারে বেতন পান না। এতে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অসমতা সৃষ্টি করে বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-যুগের দুই দশক পেরিয়ে গেলেও মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী সনদ লাভ করেছে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বিভিন্ন শর্ত পূরণ না করায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী সনদ পাচ্ছে না। স্থায়ী ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন ব্যয়বহুল শর্ত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থায়ী সনদ নিতে আগ্রহী নয় উল্লেখ করা হয়।
স্থায়ী কমিটির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়মের অভিযোগ বিভিন্ন মহল থেকে উত্থাপিত হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিতে বলে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের পক্ষে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এর আগে এই প্রতিবেদন তারা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছ থেকে সত্যায়ন করে নেয়।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী সালাউদ্দিন আকবর বলেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চাহিদা অনুযায়ী তারা দুটি প্রতিবেদন দাখিল করছেন। তবে এতে কী রয়েছে, তা তিনি জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের বিষয়সহ সামগ্রিক চিত্র, বিচ্যুতি ও উত্তরণের পন্থা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যাদি সংক্রান্ত প্রতিবেদন’ এবং ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এবং আর্থিক অনিয়ম রোধে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারে মন্ত্রণালয়ের করণীয় সম্পর্কিত প্রতিবেদন’ নামে মোট ১৯ পৃষ্ঠার দুটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
এতে মোটা দাগে (রিপোর্টের ভাষায় ‘প্রধানত’) ৮টিসহ মোট ২৪ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে ধরা হয়েছে। ওই ৮টি দুর্নীতি হচ্ছে- অননুমোদিতভাবে ক্যাম্পাস পরিচালনা, দূরশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করে সার্টিফিকেট বিক্রি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জমাকৃত স্থায়ী আমানত (এফডিআর) থেকে অর্থ উত্তোলন বা সেখান থেকে ঋণ গ্রহণ, শিক্ষার্থীদের বিনাবেতনে অধ্যয়নের সুযোগ দিতে অনীহা, দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অসহনীয় পর্যায়ে টিউশন ফি, উচ্চ ফির কারণে অনেক সময়ে শিক্ষার্থীর পড়ালেখা মাঝপথে ঝরে পড়া, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একক এবং ইউনিফর্ম (অভিন্ন) বেতন কাঠামো না থাকা প্রভৃতি।
এর বাইরে রয়েছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জমি কেনা বা ক্রয়কৃত জমি ব্যবহারের অনুমতি লাভে দীর্ঘসূত্রতা এবং স্থায়ী সনদ লাভে আগ্রহের অভাব রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে ব্যক্তি বা ফাউন্ডেশনের নামে জমি কেনার ঘটনা অহরহ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় স্বল্প পরিসর ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে যেখানে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা দ্বন্দ্ব ও মামলা সমস্যা প্রকট। এক্ষেত্রে ইবাইস, দারুল ইহসান, প্রাইমের বাইরে প্রিমিয়ার, সাউদার্নসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা খুবই করুণ। মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির বিরুদ্ধে অন্তত ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মামলা চলছে বর্তমানে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতিই বন্ধ হওয়া সম্ভব কার্যকর সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও অর্থ কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু এসব কমিটির নিয়মিত সভা না করা বা মিটিং করা হলেও তাতে সরকারি এবং ইউজিসির প্রতিনিধি না রাখা, এসব মিটিংয়ে একাডেমিকসহ সব ধরনের কার্যক্রমের কোনো অগ্রগতি না জানানো, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে প্রয়োজনীয় আয়তন, যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদির স্বল্পতা, লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বই-পুস্তক না থাকা।
সরকারের আইন না মানায় অনেক প্রতিষ্ঠানে ভিসিসহ অন্য কর্মকর্তা নেই। বর্তমানে ৭৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ৫২টিতে ভিসি, ১৮টিতে প্রো-ভিসি এবং ৩০টিতে ট্রেজারার রয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় সরকার ও কমিশনের নির্দেশনা ও বিদ্যমান আইন মানতে চায় না। এমনকি বিভিন্ন বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য চেয়ে পাওয়া যায় না। যে কারণে উল্লিখিত অনিয়ম-দুর্নীতি ঘটছে।
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. আফছারুল আমিন বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কিত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছিল। তারা ওই প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। সেগুলো নিয়ে কমিটিতে আলোচনা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে ইতিমধ্যে ইউজিসির চারটি কমিটি কাজ করছে। এর বাইরে আরও দুটি কমিটি কেন্দ্রীয়ভাবে গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
সরকারের ১৯ দফা করণীয় : এসব অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে ১৯টি করণীয়র কথা উল্লেখ করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সুপারিশ হচ্ছে আইন ভঙ্গের প্রমাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক বা স্থায়ী যে সনদই হোক তা বাতিলের ব্যবস্থা করা। এছাড়া রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত মনিটরিং বৃদ্ধি ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মিটিং এবং অন্যান্য কার্যক্রমের ওপর বিস্তারিত তথ্য ও প্রতিবেদন তলব, অবৈধ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেয়া, আদালতের স্থিতাদেশ নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত।
এ ধরনের সমস্যা নিরসনকল্পে ইউজিসির সামগ্রিক কলেবর, লোকবল বৃদ্ধি, বিভাগীয় শহরগুলোতে শাখা কার্যালয় স্থাপন ও বিশ্ববিদ্যালয় উচ্ছেদে ইউজিসিকে ক্ষমতা প্রদান, সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বেতন কাঠামো নির্ধারণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার ফি কমাতে ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ক্ষমতা প্রদান, বিনাবেতনে লেখাপড়া করানো শিক্ষার্থীদের তালিকা ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করাসহ তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঝুলানো, এফডিআরের অর্থের ব্যাপারে অ্যাকাউন্টের বিপরীতে মাসিক ব্যাংক স্টেটমেন্ট কমিশন এবং মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ, ল্যাবরেটরি এবং লাইব্রেরি খাতে অধিক পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়ার ব্যবস্থা, স্থায়ী সনদ গ্রহণের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসিকে আরও বেশি সক্রিয় হওয়া ইত্যাদি।
(যুগান্তর)